মাত্র ৫ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করে এখন ৫০ কোটি টাকার মালিক সুপ্রিয়া!

গল্পটা এক অপরাজিতা নারীর। নাম সুপ্রিয়া সাবু। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা আর দশটা ভারতীয় মেয়ের মত একই পরিণতিই যেন অপেক্ষা করছিল তার অদৃষ্টেও। ফাইন আর্টসে ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করার পরই তার বাবা তোড়জোড় শুরু করেন মেয়ের বিয়ে দেয়ার। কারণ এর বেশি আর একটা মেয়ের কী-ই বা করার আছে!

ভারতের মত একটা রক্ষণশীল দেশে এই বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি করার পর খুব ভালো কোন চাকরির সুযোগ রয়েছে, এমনটাও তো নয়। তারমানে যুক্তিসঙ্গত বিকল্প একটাই সুপ্রিয়ার বাবা-মায়ের মাথায় আসে, তা হলো মেয়েকে ধরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া। কিন্তু এই বিষয়টা একদমই মন থেকে মেনে নিতে পারেনি সুপ্রিয়া।
কিভাবেই বা পারবে! আজীবন যেই মেয়েটা স্বপ্ন দেখে এসেছে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর, খুব বড় কিছু করে চারপাশের সবাইকে চমকে দেয়ার, সেই মেয়েটাকেই যদি একদিন হঠাৎ বলা হয়, ওসব করে কাজ নেই, এরচেয়ে বরং বিয়ে করে স্বামীর সংসার করো, সেটা কি মেনে নেয়া যায়?

যায় না। সুপ্রিয়াও মেনে নিতে পারেনি। তাই জেদের বশে বাবার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় সে। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়েও একরোখা মেয়েকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে পারেন না তার বাবা। তাই শেষমেষ নিজেই নিরস্ত হন। কিন্তু সেটাও খুবই সাময়িক সময়ের জন্য। মেয়েকে এক বছরের সময়সীমা বেঁধে দেন তিনি। সুপ্রিয়া বলেন, ‘তোমার হাতে এই একটা বছরই সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে পারলে নিজে কিছু করে দেখাও, নয়ত এক বছর পর আমার কথামত যেখানে বিয়ে দেব, সেখানেই বিয়ে করতে হবে তোমাকে।’

সুপ্রিয়া দেখে, নিজেকে প্রমাণের এটাই সুযোগ। এক বছরের মধ্যে খুব বড় কোন সফলতা অর্জন হয়ত আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব। কিন্তু তাই বলে কিছু না করে হাত গুটিয়ে বসে থাকাটাও তো কোন কাজের কথা নয়। তাই বাবার দেয়া চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করে সে। কিন্তু কী করা যায়? তার যে শিক্ষাগত যোগ্যতা, সেই সমপর্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বেকার ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক মাথা কুঁটে কেউ কেউ চাকরি হয়ত পেয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেটা স্থায়ী নয় মোটেই।

সেজন্য অন্তত দুই-তিন বছর সময় তো লাগেই। অর্থাৎ অন্যের অধীনে চাকরি করে এক বছরের মধ্যে নিজের জন্য যে একটা নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা সম্ভব নয়, সেটা খুব দ্রুতই অনুধাবন করে বুদ্ধিমতি সুপ্রিয়া। কিন্তু তার হাতে যে মাত্র একটা বছরই আছে। তাই প্রচলিত পথে না হেঁটে, নিজেই কিছু করে দেখানোর চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা করে সে। ফাইন আর্টসে ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করা সুপ্রিয়ার সবসময়ই স্বপ্ন ছিল সৃজনশীল কিছু করার। আর তাই ২০০৯ সালে, মাত্র ২২ বছর বয়সে এবং ৫০০০ রুপি মূলধন নিয়ে একজন তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে সে গড়ে তোলে তার প্রথম কোম্পানিঃ মাস্টারস্ট্রোকস এডভার্টাইজিং।

কিন্তু মাত্র ৫০০০ রুপিতে কিই বা করা যাবে। একটা সফল বিজ্ঞাপনী সংস্থার জন্য প্রয়োজন আরও অনেক বেশি পুঁজির। আর এজন্য ব্যাংক লোনের চেষ্টা শুরু করে সে। কিন্তু সুপ্রিয়া পারসোনাল গ্যারান্টি ও কোন নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স প্রদান তো দূরে থাক, ব্যাংকের প্রাথমিক কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য যে প্রসেসিং ফি-র দরকার হয়, সেটাই জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়। তাই তার দেখা স্বপ্নের ওখানেই জীবন্ত সমাধি হওয়ার উপক্রম হয়।

কিন্তু ততদিনে মেয়ের প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি, অধ্যাবসায় আর হার-না-মানা মানসিকতা দেখে তার বাবার মন একটু হলেও নরম হয়। তখন তিনি এগিয়ে আসেন মেয়েকে অর্থনৈতিকভাবে কিছু সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। তিনি নিজেই মেয়ের হাতে তুলে দেন ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রাথমিকভাবে আবশ্যক অর্থ। কিন্তু তখন আরও একবার, এবং শেষবারের মত আল্টিমেটাম দিতেও ভোলেন নাঃ ‘এক বছরই রয়েছে তোমার হাতে সময়। হয় সফল হও, নয়ত আমার পছন্দ করা পাত্রের সাথে বিয়ে বসতে হবে।’

 

তবে একবার নিজের কোম্পানি দাঁড়া করে ফেলার পর সুপ্রিয়া যেন আগের চেয়েও অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। এটা যেন তার কাছে এক জীবনমরণ লড়াই হয়ে দাঁড়ায়। যে করেই হোক সফল হতে হবে তাকে। বাবার পুরুষতান্ত্রিক দম্ভকে চূর্ণ-বিচূর্ণ না করে তার শান্তি নেই। এজন্য দিন নেই রাত নেই, অক্লান্ত পরিশ্রম করে যেতে থাকে সে।মানুষের সাথে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মিশতে পারার একটা সহজাত গুণ ছিল সুপ্রিয়ার মধ্যে। সেই গুণটাকে কাজে লাগিয়ে খুব দ্রুতই সরকারি ও প্রাইভেট সেক্টরের একাধিক ক্লায়েন্ট জুটিয়ে ফেলে সে। তাদের মধ্যে ইনসা, নিবসকম, হিটাচি, স্যামসাং, রাঠি স্টিল বারসের মত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যতম।

ধীরে ধীরে তার কোম্পানির কার্যক্রমও বাড়াতে থাকে সে। শুধু বিজ্ঞাপনেই সীমাবদ্ধ না থেকে, পাশাপাশি ক্লায়েন্টদের গ্রাফিক, ওয়েব ডিজাইন, মার্কেটিং, আইডেন্টিটি ডেভেলপমেন্ট, কর্পোরেট প্রেজেন্টেশন, ফটোশপ প্রভৃতি সেবা দিতে শুরু করে তারা। এবং যত দিন যায়, অবস্থার ক্রমশ উন্নতি ঘটতে থাকে। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে তার কোম্পানির সুনাম।

বাবার বেঁধে দেয়া এক বছর সময়সীমার মধ্যেই নিজেকে দারুণ সফল একজন উদ্যোক্তা হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয় সুপ্রিয়া। ফলে বাবাও আর তার স্বপ্নপূরণের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ান না। বরং মেয়েকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেন ডানা মেলে মুক্ত আকাশে উড়বার। তারপর থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সুপ্রিয়াকে। কথায় আছে না, পরিবার যদি পাশে থাকে তবে দুনিয়ার কোন সমস্যাই আসলে খুব বড় নয়।

সুপ্রিয়াও যেন বারবার সেই কথারই প্রমাণ পেতে থাকে। চলার পথে তাকে অনেকবার হোঁচট খেতে হয় বটে, কিন্তু পরিবার ও আপনজনদের সহায়তায় ঠিকই উঠে দাঁড়াতে পারে সে। যাত্রা শুরুর মাত্র তিন বছরের মাথায়, ২০১২ সালে সুপ্রিয়া দিল্লীতে শুরু করে তার নতুন ই-কমার্স কোম্পানিও, যার নাম দেয়া হয় খৌগাল ডিলস। কয়েক বছরের মধ্যেই সেই কোম্পানির শাখা ছড়িয়ে পড়তে থাকে উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহরে। বড় বড় বিনিয়োগকারীরা বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করতে শুরু করে সুপ্রিয়ার কোম্পানিতে।

এভাবে এখন পর্যন্ত ১৪টি বড় শহরে গড়ে উঠেছে তার কোম্পানির শাখা। এবং বর্তমানে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে তার জয়যাত্রা। বিজ্ঞাপনী সংস্থা দিয়ে কাজ শুরু করা সুপ্রিয়া এখন গড়ে তুলেছে তার নিজের মুভি প্রোডাকশন হাউজও। আর মাত্র ৫০০০ রুপি নিয়ে ব্যবসা শুরুর পর সাড়ে ছয় বছরের মধ্যেই সেই ব্যবসার মূল্যমান ছাড়িয়ে গেছে পঞ্চাশ কোটি রুপি।

সুপ্রিয়ার জীবনের এই গল্প নিছকই কোন গল্প নয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের জন্য সুপ্রিয়া এখন এক মস্ত বড় অনুপ্রেরণার নাম। সুপ্রিয়ার দেখাদেখি ভারতের অনেক মেয়ের মধ্যেই এখন এ বিশ্বাস জন্মেছে যে পড়ালেখা শেষ করা মাত্রই সাতপাকে বাঁধা পড়াই কোন মেয়ের জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য হতে পারে না। বরং মনে যদি থাকে উদ্যম আর ইচ্ছাশক্তি, তবে সেগুলোকে পুঁজি করে চাইলে আকাশটাকেও ছুঁয়ে ফেলা অসম্ভব কিছু নয়।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *